হিজড়া শব্দটি কানে আসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সংঘবদ্ধ কিছু মানুষ যারা হাতে তালি দিয়ে টাকা তুলে বেড়ায়। আরও সহজভাবে বললে বলতে হবে, চাঁদাবাজি করে বেড়ায়। বিশেষ করে, ট্রেনে ভ্রমণ করেছে কিন্তু হিজড়াদের পাল্লায় পড়ে নি এমন হয়ত খুঁজে পাওয়া দুস্কর! তবে হিজড়া বলতে কি এই পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? নাকি ওদের ভিন্ন পরিচয় আছে? ওরা সাধারণ নারী-পুরুষের মত না হয়ে কেন ভিন্ন রকম হলো? আচ্ছা, ইসলাম ধর্ম হিজড়া সম্পর্কে কি বলে? ইসলামে হিজড়াদের অবস্থানটাই বা কি?
সঙ্গত কারণে আমাদের দেশে ব্লগিং এখনো তুলনামূলক প্রচার লাভ করেনি। বিশেষ করে, ধর্মীয় স্কলাররা এই সেক্টরে বেশ পিছয়ে। ফলে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নাস্তিক ও এন্টি-ইসলামরা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সফলও হচ্ছে। তাই ইসলামি স্কলারদের ব্লগিং সেক্টরে প্রভাব বিস্তার করা উচিত।
Table of Contents
হিজড়া কাকে বলে?
হিজড়া শব্দটি দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত একটি পরিভাষা। হিজড়া বলতে সাধারণত জন্মগত ও জন্মপরবর্তী শারীরিক ও মানসিক ত্রুটিযুক্ত নারীদের বোঝানো হয়।
উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, হিজড়া বলতে আন্তঃলিঙ্গ ব্যক্তিবর্গকে বোঝানো হয়, অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়।
আন্তঃলিঙ্গ অর্থ, যে ব্যক্তিদেহে নারী-পুরুষ উভয় যৌনাঙ্গ বিদ্যমান থাকে। অতীতে আন্তঃলিঙ্গ শব্দের ব্যবহার ছিল না, উভলিঙ্গ বলা হত। উভলিঙ্গ বিভ্রান্তিকর এবং অসম্মানজনক বিবেচনা করে ২০০৬ সাল থেকে আন্তঃলিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া হিজড়া বলতে রূপান্তরকামী বা রূপান্তরিত লিঙ্গের নারীদের বোঝানো হয়ে থাকে। রুপান্তরকামী অর্থ এক লিঙ্গে জন্মগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে বিপরীত লিঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান করা। অর্থাৎ শারীরিকভাবে ছেলে হলেও মানসিক ভাবে মেয়ে, এমন মানুষকেও হিজড়া হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এখানে উল্লিখিত, আমাদের চারপাশে যেসব হিজড়া দেখি, তাঁদের অধিকাংশ হিজড়াই স্বাভাবিক পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণকারী। কিছু ব্যতিক্রম আছে যারা আন্তঃলিঙ্গ বৈশিষ্ট্যধারী, তবে সংখ্যায় খুবই কম (Rare)। একই শরীরে দুই যৌনাঙ্গ ধারণকারী হিজড়াদের একটি যৌনাঙ্গ সচল ও অপরটি অচল হয়। বা দুটোই সচল থাকতে পারে। দ্বৈত যৌনাঙ্গের ক্ষেত্রে সাধারণত অবস্থান উপর নিচ বা একটির ভেতর অন্যটি হয়ে থাকে (দ্বৈত যৌনাঙ্গ সংখ্যায় খুবই নগণ্য)।
অর্থাৎ, জন্মগত বা জন্মপরবর্তী শারীরিক বা মানসিক ত্রুটিযুক্ত মানুষকে দক্ষিণ এশিয়ায় হিজড়া বলা হয়।
ইসলামে হিজড়া বলতে কি বোঝানো হয়?
অনেক সম্মানিত ভাই বলে থাকেন, ইসলামে হিজড়াকে অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ এই ধারণা সঠিক নয়। বরং হিজড়া বলতে আলাদা গোষ্ঠী বিবেচনা না করে তাঁদের নারী অথবা পুরুষ এ অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে। আসেন, আরেকটু পরিস্কার করি, আমাদের দেশে হিজড়ারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আলাদা গোষ্ঠীভুক্ত থাকে। ফলস্বরূপ কি হয়? তাঁরা (অধিকাংশ) আলাদাভাবে বসবাস করে, সমমাকিতায় লিপ্ত হয়, চাঁদাবাজি করে এবং তাঁরা পারিবারিক সম্পত্তি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
অপর দিকে ইসলাম বলেছে, তাঁদের ছেলে বা মেয়েতে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবারের সাথে সাধারণভাবে বসবাস করতে। এর ফলে আর দশটা সন্তানের মত তাঁরা সবকিছুর অধিকার পাবে।
“তিনিই মহান সত্ত্বা, যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৬)
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন, অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” (সূরা আশ-শূরা, আয়াত নং ৪৯)
বেশির ভাগ হিজড়া পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়ায় তাঁদের পুরুষ হিসেবে বিবেচিত করতে হবে। তবে কারো বাহ্যিকতায় নারীর বৈশিষ্ট্য বেশি থাকলে তাঁকে নারী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তবে যদি এমন হয়, উভলিঙ্গ হয়, তাহলে কি করা হবে? ইসলাম একটি পূর্ণ জীবনধারা। এখানে জীবনের সবকিছুর সমাধান বিদ্যমান আলহামদুলিল্লাহ। হাদিসে এসেছে-
যে ত্রুটিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে নারী বা পুরুষ কোনো একটি প্রকৃতি প্রবল, সে নারী বা পুরুষের হিসাবে উত্তরাধিকার সম্পদ পাবে। আর যার প্রকৃতি সহজে নির্ধারণ করা যায় না তার ব্যাপারে চিকিৎসকদের মতামত নেওয়া হবে। (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ১২৯৪)।
মুহাম্মদ ইবনু আলী হতে বর্ণিত, আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এমন এক ব্যক্তির সম্পর্কে প্রশ্ন এলো যার, পুরুষাঙ্গও আছে আবার স্ত্রী অঙ্গও আছে (উভয়লিঙ্গ); সে দু’টি অঙ্গের কোনটি (পুরুষ নাকি মহিলা) হিসেবে মীরাছ পাবে? তিনি বললেন, সে এতদুভয়ের মধ্যে যে অঙ্গটি দিয়ে পেশাব করে, (সে অনুযায়ী সে মীরাছ পাবে)। ( সুনান আদ-দারেমী , হাদিস : ৩০০৮)
অর্থাৎ পুরুষ নাকি মহিলা লিঙ্গ নির্ধারণে প্রাথমিক অবস্থায় লিঙ্গ নির্ধারণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এবং প্রয়োজন মাফিক চিকিৎসকের মতামত অনুযায়ী নারী পুরুষ শ্রেণিতে বিবেচ্য হবে।
অতএব, এটিই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে হিজড়া হিসেবে আলাদা শ্রেণীকরণ সমর্থন করেনা। বরং তাঁদেরকে নারী বা পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করে তাঁদের সকল প্রকার অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখে।
ইসলামিক পরিভাষায় হিজড়া
উপরে আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে, হিজড়া হিসেবে আলাদা শ্রেণিকরণ ইসলাম সমর্থন করেনা।
বাংলা হিজড়া শব্দটি হিন্দি শব্দ থেকে এসেছে। হাদিসের পরিভাষায় আরবিতে এই শব্দের শাব্দিক কোনো অর্থ নাই। তবে হ্যাঁ। হিজড়ার বাংলা শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় আরবিতে কিছু শব্দ পাওয়া যায়। যেগুলোর বাংলা অর্থ দাঁড়ায় নপুংসক, মেয়েলী পুরুষ ইত্যাদি।
বাংলা হিজড়া শব্দের আরবি শাব্দিক অর্থ হাদিসে যেটা এসেছে সেটি হলো: الْمُخَنَّثُ । এর ইংরেজি অর্থ effeminate man. যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় নির্মল বা মেয়েলি পুরুষ।
الْمُخَنَّثُ শব্দের ব্যাখ্যা হলো, সেই সব পুরুষ যারা মেয়ে সেজে থাকে।
অর্থাৎ জন্মগতভাবে যারা ত্রুটিপূর্ণ কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের অনুরূপ চরিত্র, সাজগোজ, কথা বলার ধরণ বা চালচলন নকল করার ক্ষেত্রে কোনরূপ চেষ্টা করে না তাঁদের الْمُخَنَّثُ বা effeminate person বা বাংলা শাব্দিক অর্থে হিজড়া বলা হয় না।
বরং যারা (জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ বা ত্রুটি বিহীন) বিপরীত লিঙ্গের আখলাক, তাদের চালচলন, তাদের হাবভাব, তাদের মতো কথা বলার ধরণ ও তাদের মতো সাজসজ্জা গ্রহণের চেষ্টা করে হাদিসের পরিভাষায় الْمُخَنَّثُ বা effeminate person বা বাংলা শাব্দিক অর্থে হিজড়া বলা হয়।
আরও সহজ করে বললে বলতে হবে, যেসব পুরুষ (ত্রুটিপূর্ণ বা স্বাভাবিক) মহিলাদের আখলাক, তাদের চালচলন, তাদের হাবভাব, তাদের মতো কথা বলার ধরণ ও তাদের মতো সাজসজ্জা গ্রহণের চেষ্টা করে, হাদিসের পরিভাষায় সে সব পুরুষকে হিজড়া হিসেবে সম্বোধন করা হয়। তেমনি যেসব নারী পুরুষের মত সাজসজ্জা গ্রহণ করে তাদের হিজড়া হিসেবে সম্বোধন করা হয়।
হিজড়া সম্পর্কিত হাদিস নিয়ে নাস্তিকদের মিথ্যাচার
নাস্তিকদের প্রধান কাজ সৃষ্টির অস্তিত্ব নিয়ে সংসয় প্রদান ও প্রচার করা। বাংলাদেশের নাস্তিকরা সৃষ্টির অস্তিত্ব নিয়ে যতটা না সচেতন তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে! কারণটা অবশ্য স্পষ্ট। বাংলাদেশের নাস্তিকরা প্রকৃত অর্থে যতটা না নাস্তিক, তার অধিক ইসলাম বিদ্বেষী! এই ইসলাম বিদ্বেষীরা আবার দুই ধরণের! এক গ্রুপ বুঝে বিদ্বেষী, আবার এক গ্রুপ কিছু না বুঝেই বিদ্বেষী।
সে যাই হোক! ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম। এখানে সব কিছুর সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় আলহামদুলিল্লাহ। ইসলাম বিদ্বেষী মানুষরা সাধারণত ইচ্ছাকৃত ভাবে ইসলামের ভেতরের বিষয়গুলো ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে। তাদের বেশির ভাগ জানে, তারা ভুল কিংবা মিথ্যা তবু তারা চেষ্টা চালিয়ে যায়। কারণ বাংলাদেশে না বুঝে ধর্ম পালনকারীর সংখ্যা বেশি! এই অবুঝ ধর্মপ্রাণ মানুষের ব্রেন ওয়াশ করা তুলনামূলক সহজ! তবে ধর্মের সাথে যেহেতু বিশ্বাস শব্দ যুক্ত, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্মানিত এন্টি-ইসলামী ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয়!
চলুন দেখে নেয়া যাক, হিজড়া সম্পর্কিত কিছু হাদিস।
ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষ হিজড়াদের উপর এবং পুরুষের বেশধারী মহিলাদের উপর লা’নত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ওদেরকে ঘর থেকে বের করে দাও। ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুককে বের করেছেন এবং ’উমার (রাঃ) অমুককে বের করে দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি/ আধুনিক প্রকাশনী- ৫৪৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৫৪)
হুমাইদী (রহঃ) … উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, আমার কাছে এক হিজড়া ব্যাক্তি বসা ছিল, এমন সময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি শুনলাম, সে (হিজড়া ব্যাক্তি) আবদুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়া (রাঃ)-কে বলছে, হে আবদুল্লাহ! কি বলো, আগামীকাল যদি আল্লাহ্ তোমাদেরকে তায়েফের উপর বিজয় দান করেন তা হলে গায়লানের কন্যাকে অবশ্যই তুমি লুফে নেবে। কেননা সে (এতই স্থুলদেহ ও কোমল যে), সামনের দিকে আসার সময়ে তার পিঠে চারটি ভাঁজ পড়ে আবার পিঠ ফিরালে সেখানে আটটি ভাঁজ পড়ে। [উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন] তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এদেরকে (হিজড়াদেরকে) তোমাদের কাছে প্রবেশ করতে দিও না। ইবনু উয়াইনা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, ইবনু জুরায়জ (রাঃ) বলেছেন, হিজড়া লোকটির নাম ছিলো হীত। (সহিহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুবাদ) হাদিস: ৩৯৮৮)
এরকম প্রায় ৩০ টি অধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আলোচনার গভীরে প্রবেশ করতে হলে নাস্তিক বা ইসলাম বিদ্বেষীদের বক্তব্য জানা প্রয়োজন।
হিজড়া নিয়ে আসিফ মহিউদ্দিনের মিথ্যাচার
আসিফ মহিউদ্দিন। নামটা ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছে বেশ পরিচিত। তিনি ইসলাম নিয়ে বুঝে, না বুঝে কটাক্ষ করেন এবং ইসলামকে মানুষের কাছে নেগেটিভ ভাবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন! তিনি “হিজড়াদের সম্পর্কে ইসলাম” শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখেছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, ইসলাম হিজড়াদের কোনো অধিকার প্রদান করে নি। বরং তাদের প্রতি অন্যায় করেছে! চলুন দেখে নেয়া যাক, সে হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে কি বলেছে।
অর্থাৎ আসিফ মহিউদ্দিন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে, হিজড়াদের নির্বাসিত বা বাড়ি থেকে বের করে দেয়ায় ইসলামের নিয়ম!
সম্মানিত পাঠক হয়ত ভাবছেন, ভুলটা কোথায়! এতক্ষণে হয়ত পাঠক একটা কথা ভুলে গেছেন। আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম ইসলামে হিজড়া বলে আলাদা শ্রেণীকরণ করা হয়নি। এবার হয়ত পাঠক মনে প্রশ্ন জেগেছে, যেখানে হিজড়াদের আলাদা শ্রেণি সমর্থন না করে তাঁদের নারী অথবা পুরুষ শ্রেণিভুক্ত করার বিধান ইসলামে আছে সেখানে হাদিসে হিজড়াদের নির্বাসন করার কথা কিভাবে আসলো?
তবে কি হিজড়াদের আলাদা শ্রেণীকরণের বিধান ভুল নাকি আসিফ মহিউদ্দিনের উদ্ধৃতি দেয়া হাদিসগুলো ভুল? সম্মানিত পাঠকদের অবগতির জন্য বলে রাখি, বর্ণিত সব হাদিসই সহিহ। আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে সমস্যা বা অসঙ্গতি বা বুঝের ভুল বা মিথ্যাচার কোথায়? চলুন, আলোচনার গভীরে প্রবেশ করা যাক।
হিজড়াদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার হাদিসের ব্যাখ্যা
সম্মানিত পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, হিজড়া হিসেবে আলাদা শ্রেণীকরণ ইসলামে সমর্থন করে না। বরং ইসলাম নিয়মানুযায়ী তাঁদের পুরুষ কিংবা নারীতে অন্তর্ভুক্ত রেখে তাঁদের সকল অধিকার অক্ষুণ্ণ রেখেছে। চলুন হাদিসগুলো দেখে আসি।
সম্মানিত পাঠক, এতক্ষণে হয়ত অনেকে রহস্য ভেদ করে ফেলেছেন। হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন, হিজড়া হিসেবে আলাদা শ্রেণীকরণ ইসলাম ধর্ম সমর্থন করেনা। তাই হিজড়া নিয়ে হাদিস বর্ণনার প্রশ্নই আসে না!
উপরের স্ক্রিনশর্ট গুলোতে লক্ষ্য রাখুন। বাংলা অনুবাদে শাব্দিক অর্থে যেসব হাদিসে হিজড়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সবগুলোর আরবি শব্দ مُخَنَّثٌ (mukhannath) ব্যবহৃত হয়েছে। مُخَنَّثٌ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ effeminate person। مُخَنَّثٌ এর অর্থ আলোচনার শুরুতে বর্ণনা করা হয়েছে। তবু আরেকবার জানিয়ে রাখি, مُخَنَّثٌ হলো তারা, যারা বিপরীত লিঙ্গের আখলাক, তাদের চালচলন, তাদের হাবভাব, তাদের মতো কথা বলার ধরণ ও তাদের মতো সাজসজ্জা গ্রহণের চেষ্টা করে। অর্থাৎ ছেলে হলে মেয়ে সাজে।
বিপরীত লিঙ্গের অনুরূপ সাজসজ্জা গ্রহণ বা অনুরূপ হাবভাব, চালচলন ইত্যাদি গ্রহণ সম্পর্কিত হাদিস এগুলো। مُخَنَّثٌ বা effeminate হওয়ার জন্য যৌনাঙ্গে ত্রুটি থাকতে হবে বিষয়টি এমন নয়। বরং বিপরীত লিঙ্গের হাবভাব, কথা বলার ধরণ ও সাজসজ্জা গ্রহণের চেষ্টা বা গ্রহণ করলে مُخَنَّثٌ বা effeminate person বা বাংলা শাব্দিক অর্থে হিজড়া বলে প্রতীয়মান হবে।
তবে কি বাংলা অনুবাদে হিজড়া শব্দ প্রয়োগ ভুল বা অসঙ্গতি? না এটিও ভুল না। পূর্বেই বলেছি, যারা (জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ বা ত্রুটি বিহীন) বিপরীত লিঙ্গের আখলাক, তাদের চালচলন, তাদের হাবভাব, তাদের মতো কথা বলার ধরণ ও তাদের মতো সাজসজ্জা গ্রহণের চেষ্টা করে হাদিসের পরিভাষায় الْمُخَنَّثُ বা effeminate person বা বাংলা শাব্দিক অর্থে হিজড়া বলা হয়।
এই হিজড়া মানে ত্রুটিযুক্ত মানুষ নয়। এই হিজড়া অর্থ বিপরীত লিঙ্গের অনুরূপ চালচলন ও সাজসজ্জা গ্রহণকারী ব্যক্তি। এদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ধরেন, কোনো পুরুষ মানুষ যদি শাড়ি পরে মেয়ে সেজে আমাদের বাড়িতে অবস্থান করে, যেখানে আমাদের মা-বোন বসবাস করে, তবে কি মা-বোন নিরাপদ থাকবে? প্রশ্নটা আপাতত রাখলাম। এ নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ।
অর্থাৎ, জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তি, যাদের দক্ষিণ এশিয়াতে হিজড়া বলা হয় ও তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, ইসলামে তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সমর্থন করেনা। বরং তাদের নারী পুরুষ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সর্ব অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখে। আমাদের দেশে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালে ইসলামের সৌন্দর্য প্রতীয়মান হয়। ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি তাদের নারী বা পুরুষের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হত, তাহলে তাঁরা আলাদা ভাবে বসবাস করত না। এতে তাদের জীবনমান স্বাভাবিক ও সুন্দর থাকত।
উপসংহার
আল্লাহর সব সৃষ্টি সুন্দর। আল্লাহ বলেন, “তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন, এবং এতে তাদের কোনো হাত নেই, আল্লাহ পবিত্র, মহান এবং তারা যাকে শরীক করে তা হতে তিনি উর্ধ্বে।” (সূরা-আল-কাসাস্, আয়াত নং ৬৮)
অতএব, কেউ কোনো জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে বা প্রতিবন্ধি হলে তাঁকে দূরে ঠেলে দেয়া ইসলাম বহির্ভূত কাজ। মানুষকে হিজড়া হিসেবে কটাক্ষ না করে, ছোট না করে, অধিকার হরন না করে তাদেরকে নিয়মানুযায়ী মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা আমাদের ইমানি দায়িত্ব। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়া ,মানুষকে চিকিৎসার মাধ্যমে শতভাগ সুস্থ করে তোলা যায়। আল্লাহ আমাদের সবার বুঝকে সুন্দর ও সুস্থ করে দিক। আমিন।
আব্দুর রহমান আরজ
বিএসএস (অনার্স), ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়তথ্যসূত্র
- bn.wikipedia.org/wiki/হিজড়া/
- bn.wikipedia.org/wiki/আন্তঃলিঙ্গ
- bn.wikipedia.org/wiki/রূপান্তরকামিতা
- banglanews24.com/national/news/bd/890458.details
- m.somewhereinblog.net/mobile/blog/ranadipam/28987437
- aparajeobangla.com/special-news/news/8952
- emani85.wordpress.com/2013/06/03/হিজড়া-কাকে-বলে-কত-প্রকার-ও/
- shongshoy.com/হিজড়াদের-সম্পর্কে-ইসলাম/
- sylheterdak.com.bd/2023/11/85333/
- kalerkantho.com/print-edition/islamic-life/2018/10/05/687633
- ajkerpatrika.com/316001/ইসলামে-হিজড়াদের-অধিকার-ও-বিধান
- jugantor.com/todays-paper/features/islam-and-life/531867/ইসলামে-হিজড়াদের-অধিকার
- সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ১২৯৪
- ফাতাওয়া ও প্রশ্নোত্তর, আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল, অধ্যায়ঃ দৈনন্দিন জীবন এবং সমসাময়িক বিষয় সম্পর্কে শেয়ার ও অন্যান্য
- সুনান আদ-দারেমী (হাদিসবিডি), হাদিস: ৩০০৮
- সহিহ বুখারি/ আধুনিক প্রকাশনী- ৫৪৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৩৫৪
- সহিহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুবাদ) হাদিস: ৩৯৮৮
- সহিহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুবাদ) হাদিস: ৬৩৭৩
- সহিহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুবাদ) হাদিস: ৫৮৮৬
Leave a Reply